মোহাম্মদ আনোয়ার হোসেন:
বাংলা আমার মা। হাজার হাজার বছর ধরে বয়ে চলা নদীর মতো করে ইতিহাসের প্রতিটি স্তরে স্তরে বাংলা মায়ের দামাল সন্তানের সরব উপস্থিতি। বাংলা আমার ভাষা, আমাদের আর বর্তমান পৃথিবীর সকল ভূখন্ডের রাষ্ট্র কাঠামো স্মরণ করে মায়ের ভাষাকে কখনো বদ্ধ ঘরে রাখা যায় না। বাংলাদেশ নামক ভূখন্ডের অবস্থা অনেক সূচকে প্রভূত অর্জনের পূর্ব থেকেই এ দেশের কথা বিশ্ব সভায় আলোচিত, গৃহীত এবং পালনীয় । জাতির সংঘ অধিভূক্ত সকল রাষ্ট্র আজ একুশে ফেব্রুয়ারিকে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস হিসেবে স্মরণ করছে। আমি গর্বিত পৃথিবীর শেষ যুগে দাঁড়িয়ে ভাষার জন্য তাজা রক্ত বিলিয়ে দেয় যে সন্তানরা আমিও সেই ভাষার ভাষাভাষীদের একজন। প্রখ্যাত রাষ্ট্রবিজ্ঞানী অধ্যাপক ড. হারুন-অর-রশিদ যেমন বলেছেন-১ ১৯৭১ সালে দক্ষিণ এশিয়ার আজকের যে অঞ্চল জুড়ে বাংলাদেশ সেখানে স্বাধীন রাষ্ট্রের প্রতিষ্ঠা বাঙ্গালি জাতির ইতিহাসে অবিস্মরণীয় ঘটনা।

১৯৪৭-১৯৭১ এ সময়টি ছিল মুক্তির সংগ্রামের চূড়ান্ত পর্ব বা অধ্যায়। ১৯৫২ সাল আমাদের জাতীয় জীবনে বাক প্রতিবন্ধিতার ভেতর দিয়ে নিয়ে যাওয়া থেকে মুক্তি দিয়েছে। ভাষা আন্দোলনে বাঙালির ইতিহাসের মহানায়ক, সর্বকালের, সর্বশ্রেষ্ঠ বাঙ্গালি জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান এর পক্ষে বিষয়ের গুরুত্ব অনুধাবন এবং কর্মপন্থা স্থিরীকরণ কোন সময়ের ব্যাপার ছিল না। মুক্তির সংগ্রামের শুরুতেই ভাষার প্রশ্নে বাঙ্গালিদের আন্দোলনে অবতীর্ণ হওয়া অনেকের কাছে আশ্চর্যজনক মনে হলেও, তা অসম্ভব বা অবাস্তব ছিল না। তাই, ১৯৪৮ সালের ২১ শে মার্চ ঢাকার রের্স কোর্স ময়দানের (বর্তমান সোহরাওয়ার্দী উদ্যান) জনসভায় জিন্নাহ’র “উর্দূই হবে পাকিস্তানের একমাত্র রাষ্ট্র ভাষা”। এই ঘোষণার তাৎক্ষণিক প্রতিবাদ যেসব তরুণ কণ্ঠে উচ্চারিত, তিনি তাদের মধ্যে একজন ছিলেন। আন্দোলনের সূচনা ও তা সংগঠিত করতে তিনি নেতৃস্থানীয় ভূমিকা পালন করেন২, যে কারণে সে সময়ে তাঁকে একাধিকবার কারাববরণ করতে হয়েছে। বঙ্গবন্ধু ছিলেন ভাষা আন্দোলনের প্রথম কারাবন্দীদের অন্যতম (১১ই মার্চ, ১৯৪৮)৩। একই দিন ওলি আহাদসহ আরও অনেকে গ্রেফতার হন। ১৯৫২ সালের ১৬ই ফেব্রুয়ারি ঢাকার কেন্দ্রীয় কারাগারে বন্দী থাকা অবস্থায় “ রাজবন্দীদের মুক্তি” ও “রাষ্ট্রভাষা বাংলার” দাবীতে সহবন্দী মহিউদ্দিন আহমেদ সঙ্গে নিয়ে তাঁর দীর্ঘ অনশন পালন আন্দোলনকে তীব্র করে তুলে।

বঙ্গবন্ধুর কাছে রাষ্ট্রভাষা আন্দোলন “শুধু মাত্র ভাষার আন্দোলন ছিল না, বাঙ্গালির অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক, সাংস্কৃতিক তথা সার্বিক স্বাধিকার প্রতিষ্ঠার প্রশ্ন এর সাথে জড়িত ছিল৪। ভাষার প্রশ্নে সর্বত্র তাঁর ছিল উচ্চকণ্ঠ। বাংলা ভাষার প্রতি বঙ্গবন্ধুর এই গভীর একাত্ববোধের প্রকাশ আমরা বিভিন্ন সময়ে দেখতে পাই।

ভাষা আন্দোলন বাঙালির চেতনামূলে অগ্নি স্ফুলিঙ্গ ছড়িয়ে যায়। দেশের সর্বত্র শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে নির্মিত হয় বাঙালির জাতীয় জাগরণের প্রতীক শহিদমিনার। মোহাম্মদ মাহবুবুল আলম, হাসান হাফিজুর রহমান, শামসুর রাহমান, আলাউদ্দিন আল আজাদ, আবু জাফর ওবাইদুলাহ, সৈয়দ শামসুল হক, কবি নুরুল হুদাসহ অনেকের কবিতায় তা মূর্ত হয়ে উঠে৫। শেরে বাংলা এ.কে. ফজলুল হক, গণতন্ত্রের মানসপুত্র হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী ও মজলুম জননেতা মাওলানা আব্দুল হামিদ খান ভাসানী এঁদের জীবদ্দশায়ও বঙ্গবন্ধু ছিলেন সকল আন্দোলন সংগ্রামের মধ্যমণি। ১৯৫৫ সালে পাকিস্তান গণপরিষদে ভাষা সংক্রান্ত তাঁর স্মরণীয় উক্তিটি দিয়েই এবং আমাদের কক্সবাজারের সন্তান ২০১৬ সালে ২১শে পদক প্রাপ্ত শ্রদ্ধেয় দাদা’র প্রতি শ্রদ্ধা জানিয়ে লিখাটি শেষ করছি।

অন্য কোন ভাষা জানা কিংবা না জানা আমাদের জন্য গুরুত্বপূর্ণ নয়, আমরা এখানে বাংলাতেই কথা বলতে চাই যদি আমরা এটা উপলব্ধি করি যে, আমরা বাংলা ভাষায় ভাব বিনিময়ে সক্ষম, তাহলে সকল সময়েই আমরা বাংলায় কথা বলব; এমনকি ইংরেজিতেও যদি আমাদের সমান দক্ষতা থাকে। যদি আমাদেরকে অনুমতি না দেওয়া হয় তাহলে হাউজ পরিত্যাগ করব। বাংলাকে অবশ্যই হাউজে গ্রহণ করে নিতে হবে- এটাই আমাদের স্ট্যান্ড৬।

লেখক : উন্নয়ন কর্মী